
শিশুদের দাঁতের যত্ন নেওয়া বলতে শুধুমাত্র দাঁত ঝকঝকে থাকা কে বোঝায় না, বরং দাত সুস্থ সবল ও যে কোনো রকম সমস্যা যেমন ক্যাভিটি, দাতের ক্ষয়, কিংবা পাইরিয়া ইত্যাদি সকল মুক্ত সুন্দর থাকাকে বোঝায়।
দাতের যত্ন কেবল যে দাঁত ভালো রাখতে অথবা দাঁত সুন্দর রাখার জন্যই করতে হবে এমন টা নয়, বরং সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্যও দাঁতের যত্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দাঁত কিংবা মুখ দিয়েই আমরা খাদ্য গ্রহণ করে থাকি, আর দাতে সমস্যা থাকলে তা খাদ্য্যের সাথে আমাদের দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং সংক্রমণ ঘটায়। একটি নীরোগ মুখ শিশুকে স্বাভাবিকভাবে খাবার খেতে, কথা বলতে এবং সুন্দর ভাবে হাসতে সাহায্য করে। ছোটবেলা থেকেই দাঁতের যত্নের অভ্যাস গড়ে তোলা জীবনের পরবর্তী সময়ে সুস্থ দাঁত ধরে রাখার মূল চাবিকাঠি।
কেন শিশুদের দাঁতের যত্ন গুরুত্বপূর্ণ:
যদি দাঁতে কোনো সংক্রমণ থেকে থাকে তাহলে দাঁতের সংক্রমণ শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, যেমন হার্ট এবং কিডনি, ফুসফুস ইত্যাদি। সুস্থ দাঁত সঠিকভাবে খাবার চিবাতে সাহায্য করে, যা শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ নিশ্চিত করে। সুন্দর দাঁত শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে। ছোটবেলা থেকেই দাঁতের যত্ন নেওয়া ভবিষ্যতে দাঁতের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
১. প্রথম দাঁত ওঠার পর থেকেই শুরু করুন
আমরা অনেকেই বাচ্চার দাঁত গজানো নিয়ে হেভি মাত্রায় এক্সাইটেড থাকি, আর এক্সাইট্মেন্টের চোটে আমরা ভূলেই যাই যে দাঁত ব্রাশ করাতে হবে। এছাড়াও আমরা অনেকেই কখন থেকে ব্রাশ করানো শুরু করব, সবে তো দাঁত গজালো আরও কিছুদিন যাক, আর কয়েকটা দাঁত গজাক এমন চিন্তা ভাবনা করে থাকি। যেটা সম্পূর্ণ রুপে ভূল। ১ টা দাঁত গজালে ১টাই ব্রাশ করে দিত হবে ব্যাপারটি এরকম।
শিশুর প্রথম দাঁত ওঠার পর থেকেই নরম ব্রাশ এবং পানি দিয়ে নয়মিত দাঁত ব্রাশ করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এটি দাঁতের উপর জমে থাকা খাবারের কণা এবং ব্যাকটেরিয়া দূর করতে সাহায্য করে। ২ বছর বয়সের পর থেকে ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে শুরুতে খুব সামান্য পরিমাণ টুথপেস্ট ব্যবহার করা উচিত এবং শিশুকে নিজে নিজে ব্রাশ করতে সাহায্য করতে হবে। দাঁত ব্রাশ করার সময় দুই মিনিট সময় নেওয়া উচিত। এতে দাঁতের সব দিক থেকে প্লাক এবং খাবারের কণা দূর হবে। ছোট ছোট বৃত্তাকার গতিতে দাঁত ব্রাশ করতে হবে। জিহ্বা এবং তালুও পরিষ্কার করতে হবে।

২. শিশুদের দাঁতের যত্নে নিয়মিত ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়া
শিশুর প্রথম দাঁত ওঠার এক বছর পর থেকে ডেন্টিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। এরপর থেকে প্রতি ৬ মাসে অন্তর একবার ডেন্টিস্টের কাছে গিয়ে নিয়মিত চেকআপ করানো উচিত। কারণ বাচ্চারা ঠিক ভাবে দাঁত ব্রাশ করতে চায়না, আর বাবা মা রাও ছোট বাচ্চাকে ব্রাশ করার ব্যাপারে বেশী চাপ দেন না, তাই ডেন্টিস্ট শিশুর দাঁতের অবস্থা পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন।
এছাড়াও এ সময়ে শিশুদের নতুন দাঁত গজাতে থাকে। এতে মুখে বিভিন্ন সমস্যা লেগেই থাকে। আবার অনেক সময় নতুন দাঁত আঁকাবাঁকা হয়ে গজায় যা পরবর্তী তে বড় সমস্যার কারন হতে পারে। শিশুদের দুধ দাঁত আকারে ছোটো হয়। নিয়মিত দাঁতের সুস্বাস্থ বজায় রাখতে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়। এছাড়া কোন কোন খাবার দাতের জন্য ক্ষতিকর ডাক্তার সেসব পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটি তা হচ্ছে বাবা-মা যদি তাদের যত্ন নেন তাহলে বাচ্চারাও তাদেরকে অনুসরণ করবে এবং বড়দের থেকে দেখে ছোটরা শিখবে
৩. শিশুদের দাঁতের যত্নে সুষম খাদ্যঃ
দাঁতের স্বাস্থ্য শুধুমাত্র দাঁত ব্রাশ করা বা ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়ার উপর নির্ভর করে না। আমরা যা খাই, সেটি ও দাঁতের স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
একটি সুষম খাদ্য যেমন দাঁতকে ক্ষয়ে যাওয়া কিংবা পোকার আক্রমণ (যা মূলত ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ) থেকে রক্ষা করে তেমন দাঁতকে মজবুত করে, দাঁতের গঠন মজবুত করে করে এবং মুখের মধ্যে ভালো ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে। যা মুখের দুর্গন্ধ দূরীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
কেন সুষম খাদ্য শিশুদের দাঁতের যত্নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ:
- ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস জাতীয় খাদ্য খেলে এই খনিজগুলি দাঁতকে মজবুত করে এবং ক্ষয়ের বিরুদ্ধে রক্ষা করে। এছাড়াও খাবারে থাকা ফ্লোরাইড দাঁতের ক্ষয় রোধকারী আস্তর এনামেলকে শক্ত করে এবং ক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিছু বিশেষ ভিটামিন যেমন ভিটামিন সি, ডি এবং কে দাঁতের সু স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া দাঁতকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং জিহব্বা ও মুখে অবস্থিত লালাগ্রন্থিকে সক্রিয় করে।
শিশুদের দাঁতের যত্নর জন্য ভাল খাবার:
কিছু প্রয়োজনীয় খাব্দ্য যেমন ঃ
- দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য: দুধ, দই, চিজ ইত্যাদি ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাসের ভাল উৎস।
- সবজি ও ফল: গাজর, আপেল, স্ট্রবেরি ইত্যাদি ভিটামিন এবং ফাইবারে সমৃদ্ধ।
- মাছ: মাছ ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাসের একটি ভাল উৎস।
- বাদাম: বাদাম ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামে সমৃদ্ধ।
- পুরো শস্য: পুরো শস্য ফাইবারে সমৃদ্ধ এবং দাঁতকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে।
দাঁতের জন্য খারাপ খাবার:
মিষ্টিঃবা চিনি জাতীয় খাবার: চিনি দাঁতের ক্ষয়ের প্রধান কারণ। তাই চিনি যুক্ত খাবার বিশেষ করে চকলেট বাচ্চাদের বেশ প্রিয় একটী খাবার। বাচ্চারা চকলেটের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে তাই যথাসম্ভব কম চকলেট খাওয়াতে হবে এবং প্রতিবার চকলেট খাওয়ার পর দাঁত ব্রাশ করে দিতে হবে ।
অ্যাসিডিক খাবার: এসিডিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার তাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর যেমন কলা, টম্যাটো ইত্যাদি। অ্যাসিডিক খাবার দাঁতের এনামেলকে নষ্ট করতে পারে। তাই এ ধরনের খাবার কম খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে
চিপস এবং ক্র্যাকারস: এই ধরনেরমুখরোচক খবার দাঁতে আটকে যায় এবং দাঁতের কোণায় কোণায় ঢুকে দাঁত ক্ষয়ের কারণ হতে পারে।
কার্বনেটেড পানীয়: বর্তমানে বাজারে পাওয়া সকল কোমল পানীয় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তবে এই খাবার গুলো দাঁতের মধ্যে থাকা এনামেল কোডিং নষ্ট করে দেয় এবং দাঁতে ক্ষয় হয়।
৪. শিশুদের দাঁতের যত্নে ফ্লোরাইডের ব্যবহারঃ
শিশুদের দাঁতের যত্নে ফ্লোরাইড একটি অত্যন্ত কার্যকর উপাদান। আসুন বিস্তারিতভাবে জেনে নিই কেন ফ্লোরাইড এত গুরুত্বপূর্ণ এবং কীভাবে এটি শিশুদের দাঁতকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
ফ্লোরাইড হল একটি খনিজ পদার্থ যা প্রাকৃতিকভাবে পানিতে এবং কিছু খাবারে পাওয়া যায়। এটি দাঁতের এনামেলকে শক্ত করে তোলে এবং দাঁতের ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে। ফ্লোরাইড দাঁতের এনামেলকে শক্ত করে এবং ব্যাকটেরিয়ার কারণে দাঁতের ক্ষয় হওয়ার প্রক্রিয়াটিকে ধীর করে দেয়।
নতুন দাঁত গঠনে সহায়তা দাঁত গজানোর সময় ফ্লোরাইড নতুন দাঁতকে শক্ত করে তোলে এবং ভবিষ্যতে ক্ষয় হওয়া থেকে রক্ষা করে। এবং ফ্লোরাইড দাঁতে ছোট্ট ছোট্ট ফাটল মেরামত করতে সাহায্য করে। শিশুর বয়স অনুযায়ী ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্টের পরিমাণ নির্ধারণ করা জরুরি। দাঁত ব্রাশ করার পর শিশুকে ফোঁটা ফোঁটা পানি দিয়ে কুলি করানো উচিত।
৫.শিশুদের দাঁতের যত্নে ভালো অভ্যাস গড়ে তোলাঃ
শিশুকে দাঁত ব্রাশ করার জন্য উৎসাহিত করুন। দাঁত ব্রাশ করাকে মজাদার করে তুলতে বিভিন্ন উপায় আছে, যেমন- একটি মজার টুথব্রাশ ব্যবহার করা, বা দাঁত ব্রাশ করার সময় গান গাওয়া।
শিশুদের ছোটবেলা থেকেই দাঁতের যত্ন নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধুমাত্র দাঁতকে সুস্থ রাখার জন্যই নয়, বরং সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মায়েরা শিশুদের দাঁতের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
শিশুদের ছোটবেলা থেকেই দাঁতের যত্ন নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা জীবনের বাকি সময়ের জন্য সুস্থ দাঁত ধরে রাখার চাবিকাঠি। নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করা, সুষম খাদ্য গ্রহণ এবং ডেন্টিস্টের পরামর্শ মেনে চলা দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
